দেশের রাজস্ব আয়ে ঘাটতি বাড়ায় ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ঋণ নির্ভরতা বেড়েছে। মাস শেষে সরকারি কর্মচারীদের বেতন প্রদান, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে ভর্তুকি ও সংকটে থাকা সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংকে আর্থিক সহায়তা দিতে সরকারকে ব্যাংকের ঋণের ওপর ভরসা করতে হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, গত নভেম্বরের শেষ তিন দিনে ব্যাংক খাত থেকে সরকার প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা ধার নিয়েছে। অথচ বিনিয়োগ পরিবেশের ভাটা আর আর্থিক খাতের ওপর অনাস্থার কারণে ২৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম ঋণ নিয়েছে বেসরকারি খাত।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, এসব অস্বস্তি অর্থনীতিকে দীর্ঘদিন ভোগাবে।বহু আলোচনা-সমালোচনার পর অবশেষে যাত্রা শুরু করেছে সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক। ৩৭ হাজার কোটি টাকা মূলধনের ওই প্রতিষ্ঠানে ২০ হাজার কোটি টাকা জোগান দিয়েছে সরকার। এর মধ্যে ১২ হাজার কোটি টাকা রাখা হয়েছে গ্রাহকদের আমানত ফেরত দিতে।
আর বাকি আট হাজার কোটি টাকা থাকবে প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব হিসাবে। তবে আশ্চর্যের খবর হলো, নতুন ব্যাংকে জোগান দেওয়া এই অর্থও সরকার ধার করেছে, খুঁড়িয়ে চলা ব্যাংক ব্যবস্থা থেকেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে, এ জন্য নভেম্বর শেষ তিন দিনে প্রায় ২৩ হাজার কোটি ঋণ নেয় সরকার, যা অনেকটা কইয়ের তেলে কই ভাজার মতোই!
দীর্ঘদিন ধরে রাজস্ব আদায়ে গতি না থাকায়, পরিচালন ব্যয় মেটাতে, বেশি মাত্রায় নির্ভরতা বাড়ছে ব্যাংকব্যবস্থার ওপর। অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসেই যা ছাড়িয়েছে ৩৭ হাজার কোটি টাকা।আর সে কারণে, বিনিয়োগের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ পাচ্ছে না বেসরকারি খাত। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে, অক্টোবরে বিনিয়োগকারীরা আগের অর্থবছরের তুলনায় ঋণ বেশি নিয়েছেন সোয়া ৬ শতাংশেরও কম, যা গেল ২৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। অবশ্য ব্যাংকব্যবস্থার বাইরে বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ না থাকাকেও দুষছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
এদিকে অর্থবছরের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বস্ত্র খাত সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতির ঋণপত্র খোলা কমেছে প্রায় ৩৮ শতাংশ। আর তৈরি পোশাকে সংশ্লিষ্ট খাতে ১৪ শতাংশের মতো।দীর্ঘ মেয়াদে যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ার শঙ্কায় ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা।এনবিআরের হিসাব অনুসারে, গত জুলাই-অক্টোবর সময়ে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল এক লাখ ৩৬ হাজার ৬৯৭ কোটি টাকা। এর বিপরীতে আদায় হয়েছে এক লাখ ১৯ হাজার ৪৭৮ কোটি টাকা। এ সময় রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি হয়েছে ১৭ হাজার ২১৯ কোটি টাকা। এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের হালনাগাদ চিত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
এদিকে দেশের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ও জিডিপি প্রবৃদ্ধির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি বেসরকারি খাতেই ঋণ প্রবৃদ্ধি টানা কমছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের অক্টোবরে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ৬.২৩ শতাংশে, যা গত চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগের মাস সেপ্টেম্বরে প্রবৃদ্ধি ছিল ৬.২৯ শতাংশ। ২০২৪ সালের অক্টোবরে এ হার ছিল ৮.৩০ শতাংশ। অর্থাৎ নতুন ঋণ গ্রহণ কমছে এবং বিনিয়োগের গতি শ্লথ হয়ে যাচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন—ব্যবসায়ীরা নতুন বিনিয়োগে অনাগ্রহী এবং অর্থনৈতিক পরিবেশ স্বাভাবিক না হওয়ায় উৎপাদন সম্প্রসারণের উদ্যোগও কমে গেছে।
ডলার সংকট, উচ্চ আমদানি ব্যয়, সুদের হার বৃদ্ধি এবং চাহিদা কমে যাওয়ার মতো কারণগুলো ব্যবসা পরিচালনাকে কঠিন করে তুলেছে। ফলে ঋণ নেওয়ার আগ্রহ কমছে এবং ব্যাংকগুলোও ঝুঁকি এড়াতে ঋণ বিতরণে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। ব্যাংকারদের মতে, ব্যবসায়ীরা এখন ‘ওয়েট অ্যান্ড সি’ অবস্থানে আছেন। নীতি ও বাজার পরিস্থিতি স্থিতিশীল না হওয়া পর্যন্ত বড় ধরনের বিনিয়োগে যেতে চান না। এর ফলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ব্যাহত হচ্ছে, আর শিল্প ও বাণিজ্য খাতে গতি ফিরছে না।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে নতুন বিনিয়োগে দুর্বলতা। নতুন বিনিয়োগ না করা হলে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি করা কমে যায়। তখন ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া কমে যায়। বিনিয়োগ খাত ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো সিগন্যাল নেই। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার পেছনে এটাই সবচেয়ে বড় কারণ হিসাবে ধরে নিতে হবে।
তিনি আরো বলেন, আগে জালিয়াতির উদ্দেশ্যে ঋণ নেওয়ার যে প্রবণতা ছিল, তা এখন কমেছে। পাশাপাশি আগে ডলার সংকটের কারণে আমদানি দায় মেটানোতে যে সীমাবদ্ধতা ছিল, তা-ও কিছুটা কেটে গেছে। তবে আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে জ্বালানি সংকট। অনেক কারখানা গ্যাস সংকটের কারণে উৎপাদন করতে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।



